আইবিএস সংক্রান্ত পত্রিকার খবর

রাবিতে মাতৃভাষা দিবসের বক্তৃতা অনুষ্ঠান

জাতির পরিচয় প্রকাশ হয় ভাষা দিয়ে, ধর্ম দিয়ে নয়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি

কালের কণ্ঠ

শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ‘বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষী : সংকট ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য বলেন, ‘জাতির পরিচয় প্রকাশ হয় মুখের ভাষা দিয়ে, ধর্ম কিংবা ভৌগলিক সীমারেখার মাপকাঠি দিয়ে নয়।’ রাবির ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। মঙ্গলবার বিকেলে ইনস্টিটিউটের সেমিনার কক্ষে এ বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়।তপোধীর ভট্টাচার্য বলেন, ‘মাতৃভাষার ইতিহাস আমার আবেগকে আরো বাড়িয়ে দেয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মাধ্যমে বাঙালিদের দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে। আমাদের এই ভাষা ও জাতিসত্ত্বাকে ঘিরে চতুরতা চলছে। শাসক শ্রেণির সুনজরে থাকার জন্য আমাদের নিজস্ব সত্ত্বাকে বিকিয়ে দিতে হচ্ছে। বর্তমানে চরম সংকটপূর্ণ অবস্থা অতিক্রম করছে আসাম, ত্রিপুরার বাঙালিরা। তারা বাংলা ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তারা ধরে রাখতে পারবে কিনা তা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন।

তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষার গণতন্ত্র থাকবে কিনা তা অনিশ্চিত। আমরা অদম্য বাঙালী সন্তান হওয়ার যোগ্যতা রাখি কিনা সেটা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।’

অনুষ্ঠানে আলোচক ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক জ্যোৎস্না চট্টপাধ্যায়। তিনি আসাম-ত্রিপুরার বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘বর্তমানে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে তাদের সন্তান-সন্ততিদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর প্রবণতা বেড়ে গেছে। এমনকি ভারতে যেসব অঞ্চলে বাংলা ভাষার প্রচলন রয়েছে তার অনেক জায়গাতেই ইংরেজির পর দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এতে করে বাংলা ভাষার সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। ত্রিপুরা, আসামের সংকট শুধু আমাদের সংকট নয়, পুরো বাঙালিদের সংকট।’

তিনি বলেন, ‘বাঙালিদের সাহিত্য পড়ার ঝোঁক আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে। সভ্যতার অগ্রগতির ফলে আজ এই পরিণতি। ভাষা চর্চার যেই ক্ষেত্র রয়েছে তাকে লোকজীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। বাঙালীদের যেই বৃহৎ ঐক্যের মাধ্যমে আমাদের বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।’

আরেক আলোচক শিক্ষাবিদ ও গবেষক গোলাম মুরশিদ বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ফলে আমাদের বাংলা ভাষা আজ পতনের দিকে এগুচ্ছে। বাংলাদেশ এক ভাষার সমাজ। কিন্তু এই সমাজেই এখন বাংলা ভাষার অস্তিত্ব হুমকির মুখে। আমরা বাংলার বানান লিখতে সতর্ক নই। প্রতিনিয়ত আমরা বানানে ভুল করছি। ভাষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বানানের সংস্কার করলেও আমরা সেগুলোকে জানার চেষ্টা করছি না। ফলে ভুলগুলো থেকেও আমরা বের হতে পারছি না। ঠিকভাবে ব্যবহার করছি না। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের বাংলা ভাষার যে গৌরব রয়েছে বিশেষ করে ধ্রুপদী সাহিত্যের গৌরব আমরা অচিরেই হারিয়ে ফেলবো।’

সবশেষে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন প্রধান অতিথি রাবি উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান। বাংলা ভাষার এই সংকট থেকে উত্তরণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষার এই সংকট তৈরি মূলত শাসকদের হাতে। শাসক শ্রেণির ধর্মান্ধতা ও লোভ এই সংকটকে আরো প্রবল করছে। যুগের সঙ্গে আমাদের রুচিরও পরিবর্তন হচ্ছে। আর এই পরিবর্তন আমাদের ভাষা ব্যবহারের ওপর প্রভাব ফেলছে।

তিনি আরো বলেন, ‘মানুষকে ধর্ম, বর্ণ দিয়ে বিচার না করে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। শাসকদেরকে তাদের ভাষার উৎকর্ষ সাধনের চিন্তা থাকতে হবে। সাধারণের সচেতনতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে ভাষা নিয়ে চলমান সংকট নিরসনে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হবে। তবেই এসব সমস্যা সমাধান হবে।’

আইবিএস’র পরিচালক জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, ইনস্টিটিউটের শিক্ষকসহ রাবির বিভিন্ন বিভাগের অর্ধ শতাধিক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০২:২৬